শিরোনাম
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ | ০৩:২৬ পিএম, ২০২২-০৩-১৫
আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ভোক্তা-অধিকার দিবস ২০২২। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে রয়েছে তার 'ভোক্তা অধিকার'। এ অধিকার সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু সে সচেতনতা সৃষ্টি না হওয়ায় ভোক্তারা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার থেকে।
১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। ভোক্তার চারটি অধিকার সম্বন্ধে তিনি আলোকপাত করেন। এগুলো হলো- নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরও বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরও আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করে। কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে দিনটিকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসাবে বৈশ্বিকভাবে পালন করা হয়।
বাংলাদেশে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ ও ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কাজ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে সরকার ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করে। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ অধিদপ্তর।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা.এম এম মাজেদ তাঁর কলামে লিখেন...একটি দেশে নাগরিকদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য রাষ্ট্র নাগরিকদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করে থাকে, যেগুলোকে বলা হয় নাগরিক অধিকার। আর এ নাগরিক অধিকারগুলোর মধ্যে ভোক্তা অধিকার অন্যতম।
একজন নাগরিকের বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। এর কিছু প্রদান করে থাকে পরিবার, কিছু করে রাষ্ট্র। তবে অন্যান্য অধিকার থেকে ভোক্তা অধিকার কিছুটা ভিন্ন।
যিনি উৎপাদিত পণ্য ও সেবা চূড়ান্ত ভোগের জন্য ক্রয় করেন, অর্থনীতির ভাষায় তাকে ভোক্তা বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যিনি কোনো পণ্য ক্রয় করেন কেবল নিজে ভোগ করার জন্য; তিনিই ভোক্তা।
একজন ব্যক্তি যখন কোনো পণ্য ক্রয় করেন, তখন তার জানার অধিকার রয়েছে পণ্যটি কবে উৎপাদিত হয়েছে, কোথায় উৎপাদিত হয়েছে এবং এর কাঁচামাল কী কী, মূল্য কত ইত্যাদি।
এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। যদি কোনো বিক্রেতা এসব প্রশ্নের উত্তর না দেন বা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন আইন অনুযায়ী তাতে ভোক্তা অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি।
এগুলো হল- মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার।
পণ্য ক্রয়ে প্রতারণার হাত থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে বহুল প্রতীক্ষিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনের ফলে কোনো ভোক্তা পণ্য ক্রয়ে পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, মূল্যসহ কোনো বিষয়ে প্রতারিত হলে তার প্রতিকার পেয়ে থাকেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি সম্পর্কে অবগত নয়। এমনকি শিক্ষিত সমাজের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যেও এই আইন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই।
এই আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার দরুন প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে।
বর্তমানে অনলাইনে কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে পণ্যের যে মান উল্লেখ থাকে, মূল্য পরিশোধের পর পণ্য হাতে পেয়ে দেখা যায়- বর্ণিত গুণাগুণ সেই পণ্যের মধ্যে নেই।
তাই ভোক্তাকে এই আইন সম্পর্কে জানতে হবে এবং নির্ধারিত পন্থায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে। তাহলেই অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাও কমে আসবে।আর ২০০৯ সালে প্রণীত ভোক্তা অধিকার আইনে মোট ৮২টি ধারা রয়েছে। এছাড়াও কয়েকটি ধারার উপধারা রয়েছে। আমি ভোক্তা অধিকার আইনের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। ৩৭ ধারা মোতাবেক পণ্যের মোড়ক না থাকলে বা মোড়কে পণ্যের তথ্য না থাকলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৩৮ ধারায় পণ্যের দাম সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। ৩৯ ধারায় উল্লেখ করা আছে, সেবার দাম সংরক্ষণ এবং সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৪০ ধারা অনুযায়ী, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, সেবা বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৪১ ধারা অনুযায়ী ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪২ ধারা অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৪৩ ধারায় উল্লেখ আছে, জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্য অবৈধ উপায়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৪৪ ধারায় উল্লেখ আছে, পণ্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন ইত্যাদি।
পণ্য কিনে প্রতারিত হলে অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি খুবই সহজ। বর্তমানে প্রত্যেকের হাতে হাতে স্মার্টফোন। গুগোল প্লে-স্টোরে সংরক্ষিত ‘ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ’ অ্যাপসের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা যায়।আর ২০০৯ সালের আইনটি হওয়ার আগে কমবেশি ৪০ টি আইন ও ধারা বিচ্ছিন্নভাবে ভোক্তা অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। ২০০৯ সালের আইনের মাধ্যমে সবগুলো প্রাসঙ্গিক বিষয় একসাথে করা হয়।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে আরো যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আইন আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিএসটিআই অধ্যাদেশ ১৯৮৫, অত্যাবশ্যক পণ্যসামগ্রী আইন ১৯৫৬, নিরাপদ খাদ্য আইন ১৯৫৯, পণ্য বিক্রয় আইন ১৯৩০, ওজন ও পরিমাপ আইন ১৯৮২ ও এক্রেডিটেশন বোর্ড আইন ২০০৬। সবগুলো আইনেই ভোক্তা অধিকারের কথা বলা আছে
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। তারা বহুদিন থেকেই এধরনের আইন বাস্তবায়নের সুফল পেয়ে আসছে। নাগরিকদের ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়ে থাকে। একটি কার্যকর ভোক্তা আইনের ফলে সেসব দেশে জনস্বার্থ তথা ভোক্তা অধিকার আজ একটি প্রতিষ্ঠত বিষয়।
ব্যবসা-বাণিজ্য তথা ভোক্তা অধিকারের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা দাম দিয়ে ভেজাল পণ্য ও সেবা ক্রয় করি। এ নিয়ে নাগরিকরা কোনো প্রতিবাদ করে না। রাষ্ট্রও নির্বিকার। কিন্তু অন্যান্য দেশে ভোক্তা অধিকার লংঘনের কথা ভাবাও যায় না।
ভোক্তা অধিকার লংঘন করলে অনেক দেশে বিক্রেতার লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল করা হয়। শুধু তাই নিয়, আছে ফৌজদারি দণ্ডও। তাই আইনের বাস্তবায়নটাই বড় কথা।
যেকোনো দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু আমাদের মাঝে অর্থাৎ ভোক্তাদের মাঝেই সে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। ফলে, ভোক্তারা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার থেকে।
মিথ্যাচার, ভেজাল, ফর্মালিন আজ ভোগ্যপণের সাথে মিশে গেছে। এমনকি ওষুধ দিয়ে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। বাজারের শাক-সবজি, ফল-মূল সব কিছুতেই ফরমালিন।
আইন প্রণয়নের পর বিভাগ, জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় বাজার মনিটরিং ও অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে এ আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এ লক্ষ্যে মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে অভিযান পরিচালনার সংবাদ দেখা যায়। এটিকে আংশিকভাবে এ আইন বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু জনগণের দোড়গোড়ায় এ আইনকে পৌছে দিতে★ইসলামের দৃষ্টিতে ভোক্তা অধিকার আমাদের করণীয়ঃ-
ভেজাল একটি বহুল প্রচলিত বাংলা শব্দ। এর অর্থ হলোঃ নিকৃষ্ট, খাঁটি নয় এমন নিকৃষ্ট দ্রব্য মিশ্রণ, গণ্ডগোল, ঝামেলা, বিশৃঙ্খলা “মোসলে উদ্দিন, আধুনিক আরবী বাংলা অভিধান, ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৫, পৃ. ৬৩৯”। অন্যভাবে বলা যায়, ভেজাল বলতে নিকৃষ্ট পদার্থ মিশ্রিত, কৃত্রিম মেকি কোন কিছু বুঝায়। ইংরেজীতে একে, Adulterant, contaminant, impurity, trouble, tangle, hitch, snag, spurious, corrupt. প্রভৃতি শব্দে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। নিকৃষ্ট পদার্থ যা উৎকৃষ্ট পদার্থের সাথে মিশানো হয় কিংবা নিকৃষ্ট পদার্থ মিশ্রিত খাঁটি বা বিশুদ্ধ নয় এমন যে কোনো বস্তুকে ভেজাল বলে। “শৈলেন্দ্রবিশ্বাস, সংসদ বাংলা অভিদান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪৯” মহান আল্লাহ বলেন, “সে পবিত্র বস্তু হালাল করে ও অপবিত্র বস্তু হারাম করে। “আল কুরআন, ৭:১৫৭” এ ভেজালের মহাসমারোহ চলছে বিশ্বব্যাপী নানা কৌশলে, মুখরোচক স্লোগানে ও অভিনব পদ্ধতিতে। তবে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভেজালেরও বিভিন্ন রূপ লক্ষ্য করা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে পরিচালিত ভেজাল বিরোধী অভিযানে ভেজালের যে বীভৎস চিত্র ধরা পড়েছে, তা দেশবাসীকে একদিকে হতবাক করেছে, অন্যদিকে জন্ম দিয়েছে হাজারো প্রশ্নের; তবে কি ভেজাল প্রতিরোধ করার জন্য কোনো আইন নেই? নাকি তার প্রয়োগের অভাব?
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। “আল-কুরআন, ৩:১৯” এতে মানুষের জন্য যা অকল্যাণকর ও নিকৃষ্ট সেসব বস্তু, পণ্য ও বিষয় হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতএব ইসলামের দৃষ্টিতে ভেজাল পণ্যের উৎপাদন, বিপণন ও সংরক্ষণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং অবৈধ। নিম্নে ভেজাল সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো-
পণ্যদ্রব্যের ভেজাল প্রবণতার ফলে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য অস্বাস্থ্যকর ও বিভিন্ন রোগের নিয়ামক শক্তিরূপে পরিণত হয়। খাবার হতেই যেমন মানুষের রক্ত তৈরী হয় তেমনি তা হতেই রোগের উৎপত্তি ঘটতে পারে। ফলে এর বিষাক্ত ছোবলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কুরআন মাজীদে এ ধরনের গুপ্ত হত্যাকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে উল্লেখ আছে, “এ কারণেই বনী ইসরাঈলের প্রতি এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্নক কর্ম করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকে হত্যা করল।” “আল-কুরআন, ৫:৩২” খাদ্য ও পণ্যে ভেজাল দেয়ার ফলে শুধু যে ব্যক্তি ভেজালদানের কাজে জড়িত ব্যক্তি অপরের ক্ষতিতে সচেষ্ট হয় তা-ই নং বরং সে নিজেও অন্যের ভেজালে আচ্ছাদিত হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কেননা সে তো এ সমাজেরই একজন সদস্য। মহান আল্লাহ এমন কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কুরআন মাজীদে উল্লেখ আছে, “তোমরা একে অপরকে হত্যা করো না”। “আল-কুরআন, ৪:২৯” এছাড়া এ মর্মে হাদীস এসেছে, “নিজের কিংবা অন্যের ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না।” “ইমাম ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-আহকাম: মান বানা ফী হাক্কিহি মাইয়া দুররু বি-জারিহি, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, রিয়াদ: দারুস সালাম, ২০০০, পৃ. ২৬১৭”
কোনো কিছু ক্রয় করার ক্ষেত্রে একজন ক্রেতা বিশ্বস্ত বিক্রেতা অন্বেষণকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকে যাতে তার ক্রয়কৃত পণ্যদ্রব্য ওজনে সঠিক, গুণগত মান সংরক্ষণ এবং সাশ্রয়ী হয়। পণ্য বিক্রয়ে মাপে বা ওজনে কম দেয়া এক প্রকার ধোঁকা। জাহেলী যুগে মুনাফাখোররা এ কাজ করতো। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা মাপ ও ওজনের কাজ ন্যায্যভাবে সুসম্পন্ন করবে। সাধ্যের অতীত কাজ করতে আমরা কাউকে বাধ্য করি না”। “আল-কুরআন, ৬:১৫২” আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন ঃ “তোমরা মাপার কাজ যখন করবে তখন পূর্ণ করে মাপবে। আর সুদৃঢ় দাঁড়িপাল্লা দ্বারা ওজন করবে। এ নীতি অতীব কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে খুবই উত্তম ও ভাল”। “আল-কুরআন, ১৭:৩৫” এ মর্মে আরো বলা হয়েছে, “মাপে (ওজনে) যারা কম দেয় তাদের জন্য বড়ই দুঃখ। তারা যখন লোকদের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয় তখন পুরাপুরি গ্রহণ করে। আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় তখন কম দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা যে কঠিন দিকে পুনরুত্থিত হবে সেদিক সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়িয়ে যাবে।” “আল-কুরআন, ১-৬” এবং “তোমরা মাপে পূর্ণ মাত্রায় দেবে, লোকদের জন্য ক্ষতিকারক হয়ো না। আর সঠিক পাল্লায় ওজন কর। লোকদের দ্রব্যাদি কম দিও না এবং পৃথিবীতে সীমালঙ্ঘন করো না।” “আল-কুরআন, ১৮৩” রসূল স. বলেছেন, “কোন জিনিস বিক্রি করলে মেপে বিক্রি কর এবং কোন জিনিস ক্রয় করলে মেপে নাও”। “বুখারী, খন্ড-২, পৃঃ ৩৩৩” আর পণ্যে ভেজাল থাকলে তা বিক্রেতার প্রতি অবমাননা ও অবমূল্যায়ণ এবং প্রতারণার শামিল। এ মর্মে রসূল স. বলেন, “এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কিছুই নেই যে, তুমি এমন ব্যক্তির সাথে মিথ্যার আশ্রয় নেবে যে তোমাকে বিশ্বাস করে।” “ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায়: আল-আদাব, অনুচ্ছেদ: ফিল-মাআরীদ, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, রিয়াদ: দারুস সালাম, ২০০০, পৃ. ১৫৮৭” অন্য এক হাদীসে এসেছে, “যে ব্যক্তি আমাদের সাথে প্রতারণা করে, সে আমাদের অর্ন্তভুক্ত নয়।” “ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: আল-ঈমান, অনুচ্ছেদ: মান গাশশানা ফা লাইছা মিন্না, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, রিয়াদ: দারুস সালাম, ২০০০, পৃ. ৬৯৫” সুতরাং ভেজাল ব্যবসায়ী ইসলামের গণ্ডিবহির্ভূত বলে গণ্য হবে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। মানুষে মানুষে শ্রেণিবৈষম্য নেই। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। ইসলাম সাম্যের মিছিলে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। নামাজের সারিতে সব শ্রেণির মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রাণের ধর্ম ইসলামে অধিকারের বিভাজন নেই। রাজা-প্রজা সমান। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি সাধারণ মানুষের অধিকারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। দেশের নাগরিকদের সুখ ও শান্তিময় পরিবেশ নিশ্চিত করতে ইসলাম শাশ্বত সুন্দর বিধান দিয়েছে।
> ওজনে কম দেওয়া যাবে নাঃ- ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করেছেন। স্পষ্ট ভাষায় অধিকারের ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং ভোক্তা অধিকারের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বরোপ প্রদান করতে হবে। ভোক্তার মৌলিক চাহিদা পূরণ যেমন—খাদ্য, পানীয়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার প্রতি নজর দিতে হবে। ভোক্তাকে ঠকানো যাবে না। খাদ্যে ভেজাল দেওয়া যাবে না। ভোক্তাকে পরিমাপে কম দেওয়া অপরাধ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ন্যায্য ওজন প্রতিষ্ঠা করো। এবং ওজনে কম দিয়ো না।’ (সুরা : রহমান, আয়াত : ০৯)
মাপে কম প্রদানকারী আল্লাহর কাছে ঘৃণিত। এমন মানুষ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মাপে পূর্ণমাত্রায় দেবে, যারা মাপে কম দেয় তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। এবং মানুষকে তাদের বস্তু কম দিয়ো না।’ ( সুরা : শুআরা, আয়াত : ১৮১-১৮৩)
> ইসলামের দৃষ্টিতে পণ্যের সঠিক তথ্য জানানোঃ-
পণ্য সম্পর্কিত সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ভোক্তাকে অবগত করতে হবে। পণ্যের ত্রুটি গোপন রাখা অপরাধ। অনলাইনে পণ্য বিক্রির সময় আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। যথাযথ গুণাগুণ ও দোষ বর্ণনা করতে হবে। মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘মুসলমান ভাই ভাই। কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে সে তার ভাইকে না জানিয়ে তার কাছে ত্রুটিযুক্ত কোনো কিছু বিক্রি করবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
> ইসলামে মজুদদারি পাপঃ-
ভোক্তা অধিকারের ক্ষেত্রে যেসব পথ-পদ্ধতি মানুষের জন্য ক্ষতিকর ইসলাম তা নিষিদ্ধ করেছে। পণ্যের চাহিদা ও বাজার পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে অনেক ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ করে। কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করে অধিক লাভবান হওয়ার লক্ষ্যে বহু দিন ধরে পণ্য মজুদ করে। ফলে বাজারে পণ্যাভাব দেখা দেয়। চড়া মূল্য উঠে পণ্যের দাম। ভোক্তারা অসুবিধা ও কষ্টে পড়ে। ইসলাম পণ্য মজুদদারিকে অভিশপ্ত করেছে। তাকে পাপিষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছে। হাদিসে এসেছে, ‘পাপিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া কেউ মজুদদারি করে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬০৫, সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১২৬৭)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের (সমাজে) খাদ্যদ্রব্য মজুদদারি করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দরিদ্রতার কশাঘাতে শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৫)
ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদকরণ রোধ করার পদ্ধতি হিসেবে রাষ্ট্রকর্তৃক ব্যবস্থা নিতে পারে। মজুদকারীর ওপর শাস্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে রাষ্ট্রের জন্য ভবিষ্যৎ বিপদ মোকাবেলা ও জনকল্যাণার্থে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি গুদামজাত করা বৈধ।
> পণ্য সরবরাহকারী লাভবান হয়ঃ-
কল্যাণ প্রার্থনায় সওয়াব আছে। মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ইসলামের শ্রেষ্ঠ মানুষ। মানুষের জন্য উত্তম পণ্যের ব্যবস্থাপনাকারী আল্লাহর রহমতে থাকবে। নির্ভেজাল ও উপকারী পণ্য আমদানিকারীর রিজিকপ্রাপ্ত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমদানি পণ্য সরবরাহকারী ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় এবং মজুদদার অভিশপ্ত।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৩)
> ইসলামে ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতারণা নিষিদ্ধঃ-
প্রতিটি শহরের বাজারে বাজার কমিটি আছে। বাজার কমিটির উচিত বাজার তদারকি করা। নির্বিঘ্ন বাজারব্যবস্থা উপহার দেওয়া। পণ্যের কোনো ত্রুটি থাকলে ক্রেতাকে অবগত করা আবশ্যক। ত্রুটিযুক্ত পণ্যকে সামনে প্রদর্শন করতে হবে। দোষ-ত্রুটি গোপন রেখে কোনোভাবেই ক্রেতাকে ঠকানো যাবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) একবার একটি খাদ্যদ্রব্যের স্তূপের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি তাতে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁর হাতে আর্দ্রতা অনুভব হলে বলেন, হে খাদ্য বেপারী, এ কী? সে বলল, আল্লাহর রাসুল, এতে বৃষ্টির পানি লেগেছিল। তিনি বলেন, সব খাদ্যের ওপর তা রাখলে না কেন? তাহলে লোকে তা দেখতে পেত। অতঃপর তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৩১৫, ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২২৪) এভাবেই ইসলাম ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করেছে। হবে। সচেতন করতে হবে সবাইকে।
পরিশেষে,আমাদেরকে শিকার করতে হবে যে বাংলাদেশে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার আওতায়তার মধ্যে অন্যতম জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যদিও তাদের লোকবল অনেকখানি কম তারপরেও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার প্রশ্নে তারা বাংলাদেশের অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে একটু আলাদা। আশা করি তারা তাদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা ধরে রাখবে এবং মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে।
লেখক, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন" কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ।
প্রতিষ্ঠাতা,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
ইমেইল, drmazed96@gmail.com
আমাদের ডেস্ক : : বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ নামে পরিচিত হালদা নদী নিয়ে বহুল প্রচারিত একটি ভূল মতবাদ রয়েছে। মতবাদটি হ...বিস্তারিত
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ : সোমবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৯...বিস্তারিত
আমাদের ডেস্ক : : সারা বিশ্বের মধ্যে করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বে অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে। এর ফলে সারা ব...বিস্তারিত
মুহাম্মদ আমির হোছা্ইন :: : মুহাম্মদ আমির হোছাইন ভূগোল ইতিহাসের ভিত্তি।আর মানুষের কর্মকান্ড কোন এক ভৌগোলিক পরিবেশে সংঘটি...বিস্তারিত
আমাদের ডেস্ক : : পদ্মা সেতু নিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব লেখালিখি হচ্ছে।প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্তে সেতুর নান...বিস্তারিত
মুহাম্মদ আমির হোছা্ইন :: : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে নদীয়া জেলার সদর, প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে পলাশীর যুদ্ধ ভাগীরথীর নদীর তীরে পলা...বিস্তারিত
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৯ - © 2024 Dainik amader Chattagram | Developed By Muktodhara Technology Limited